করোনার উল্টোপূরাণ -কোভিড ১৯ পরবর্তী এক নতুন পৃথিবী

                                       করোনার উল্টোপূরাণ - শ্রী প্রদীপ কুমার রায়। 

ইমেজ ক্রেডিট- ফেসবুক 

করোনা এসে প্রকৃত শিক্ষিত ও অশিক্ষিত দুইয়ের মধ্যে প্রভেদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যখন শপিং মল এর ফুড জোন, ই কমার্স সংস্থাগুলি খাদ্যসামগ্রীর জোগান দিচ্ছে না, প্রাণ ভয়ে,লোকবলের অভাবে, তখন পাড়ার  মুদির দোকান  , যেমন আমাদের ঘোঁতন  রাত এগারোটা- বারোটা পর্যন্ত জেগে জিনিসপত্র দিচ্ছে। সে তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত মানুষ নয়, কিন্তু বিবেচক, প্রতি বাড়ি পিছু দুই কিলো আলু, একটা দুধের প্যাকেট বরাদ্দ, কারন  সবার এখন প্রয়োজন।  অক্সফোর্ড ফেরত আমলা মায়ের পশ্চাতপক্ক ছেলে নয়, যে সকলকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। চেনা ছকের বাইরে গিয়ে চির প্রতিদ্বন্দ্বী শাশুড়ি ও বৌমা কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে, তারা এখন সহযোদ্ধা, প্রাণ বাঁচুক, তাহলে ঝগড়া বেঁচে থাকবে। এটাই  করোনার করিশ্মা। যে ছানাটি বলতো, বেগুন খেলে মুখ চুলকোয়, সে সোনামুখ করে নিমবেগুন খেয়ে নিচ্ছে, কাঁচা কলার খোসা বাটা, পটলের খোসা বাটা, সব কিছুই অমৃত এখন। পিত্জা, বার্গার এ অভ্যস্ত প্রজন্মকে কান ধরে করোনা শেখাচ্ছে , বাঁচার জন্য খাবার প্রয়োজন। সেইসব অহংকারী  বাবা ও মায়েদের শিক্ষা হলো এবার , আমার বাচ্চা অমুক ব্র্যান্ড ছাড়া খাবার খায় না, অমুক রেস্টুরেন্ট ছাড়া যায় না ,তাদের জন্য করোনার কঠোর শিক্ষা। বাড়ির কাজের দিদিটিও যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তার ছুটি, তার সুস্থ থাকা, বিশ্রাম আমরা কতটুকু ভাবি বা জানি, করোনার করুণায় সে ছুটি পেল, বিশ্রামও পেল। আমার বাবু কিচ্ছুটি পারে না,আমার রাজকন্যা তো সোনামণি , কাজ করলে হাত ক্ষয়ে যাবে,মোম এর পুতুল , বাবু এখন ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে আর সোনামণি বাসন মাজছে।  তাদের জন্য করোনার কঠোর শিক্ষা।

পারমাণবিক বোমা, মিগ বা রাফায়েল বিমান দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে মানুষের প্রাণ নেওয়া যে অনেক সোজা কাজ কিন্তু মানুষের প্রাণ বাঁচানো যে অনেক কঠিন কাজ সেটা আজ অনেক রাষ্ট্রনায়করাও বুঝতে পারছেন!নানা আদর্শে অনুপ্রাণিত আত্মঘাতী জঙ্গি রাও আজ প্রাণ ভয়ে ডেরায় সেঁধিয়ে গেছে! নাগরিকত্বের প্রমাণ ছাড়াই আজ দেশজুড়ে লোকজন প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেদের নাগরিকত্বের কর্তব্য পালন করল, কোন সরকারী দপ্তর থেকে আজ তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিয়ে তারপর নাগরিকের দায়িত্ব পালন করতে গেজেট নোটিফিকেশন করেনি!অনেক সংশোধনাগারের জেল বন্দীরা বাইরের মুক্ত মানুষদের জন্য লক্ষ লক্ষ মাস্ক তৈরীতে আজ ব্যস্ত!সারাবছর প্ররোচনা জোগানো নেতারা আজ সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে , প্রকৃত জননেতারা আজ মানুষের নেতৃত্বে! ঘৃনার বদলে ভালোবাসা রাজ করছে চারদিকে! মৃত্যুভয় ভীষন নিষ্ঠুর, জীবনের থেকে প্রিয় আর কিছু নেই! তাই আজ পৃথিবীটা খুব অচেনা লাগছে! কোভিড ১৯ পরবর্তী পৃথিবী এক নতুন পৃথিবী হবে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া মানুষদের জন্য!

ইমেজ ক্রেডিট- ফেসবুক 
মুরগী ডিম দেয়। একটি ডিমের দাম মাত্র আট/দশ টাকা। কিন্ত ডিম দিয়েই সে 'কক কক' আওয়াজ করে সমগ্র বাড়ির লোকদের জানিয়ে দেয় যে, সে 'ডিম' প্রসব করেছে। অথচ ঝিনুক-কে দেখুন। লক্ষ-কোটি টাকার মুক্তা দিয়েও নিরবে-নিভৃতে থাকে। আপনি ঝিনুকের মত দামি হতে চান?তাহলে বিশেষ অনুরোধ: লোক দেখানো দান বন্ধ করুন। যাদেরকে আপনারা খাবার দিচ্ছেন তারা পরিস্থিতির শিকার, ভিখারি নয়! দয়া করে ছবি তুলে তাদের লজ্জিত করবেন না।মানুষ সামান্য দান করেই নিজেকে দাতা হিসেবে, সকলের সামনে তা তুলে ধরে ! মানুষ মৃত্যু অবধারিত জেনেও, এমন ভাবে জীবন নির্বাহ করে, যেনো সে কখনও মরবেই না! অথচ মৃত্যু উপস্থিত হয়েই যায়। আর মানুষ তখন এমন ভাবে ভেঙে পড়ে যেনো সে কখনও জানতোই না তার মৃত্যু নিশ্চিত ছিলো! আর মৃত্যু কখনও বলে কয়ে আসে না! আর মানুষ সর্বদা অপ্রস্তুতই থাকে।আমরা মানুষরা  নিজেদের কতো চালাকই  না ভাবি! আসলে বস্তুত আমাদের মতো বোকা অন্য কোনো প্রানীই হয়তো নেই। কারন আমরা জগতের শ্রেষ্ঠ জীব তথা বুদ্ধিমান প্রানী হয়েও সবচাইতে বড় বোকামীটা আমরাই করি। 

ক্ষুদ্র এক ভাইরাস গোটা দুনিয়ার ভোল পাল্টে দিচ্ছে । পাল্টে দিচ্ছে আমাদের মানসিকতা, আমাদের জীবনযাত্রা। একদিকে সীমান্ত মুছে গিয়ে গোটা পৃথিবী দাঁড়িয়েছে এক আকাশের নীচে, অজানা অচেনা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে একজোট হয়ে। এরপর ঘরবন্দী হয়ে যাওয়া মানুষ প্রাথমিক ধাক্কাটুকু সামলে হাত বাড়িয়ে দেবে প্রতিবেশীর দিকে। চারপাশের পরিবেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার আগে ভাববে আত্মীয়, বন্ধু, পড়শীদের কথা। নতুন পৃথিবীতে নতুনভাবে নামবে মানুষ, ভাঙাচোরা অর্থনীতি, থমকে যাওয়া শিল্প, আমূল বদলে যাওয়া জীবনকে নতুন করে বাঁধতে। ধূলো-ধোঁয়া-অন্ধকার পেরিয়ে সেই নতুন পৃথিবীর সোনালী আলোর রেখা হয়ত দেখা যাবে  এরপর থেকেই !  গোটা পৃথিবী লকডাউন, যেন নীল ডাউন হয়ে ভাইরাসের কাছে প্রাণভিক্ষে চাইছে। মংগলগ্রহে যাওয়ার এবং বাস করার সব আয়োজন আমরা করে ফেলেছি, কত শক্তিশালী আমরা, অথচ কত শক্তিহীন! এই সময় আমরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলেও মানসিক দূরত্ব যেন ঘুচিয়ে ফেলি। ভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, আমরা মানুষ -- এই আমাদের আসল পরিচয়। নারী পুরুষ, হিন্দু ,মুসলিম , বৌদ্ধ  , খ্রিস্টান  ,ইহুদি  , নাস্তিক, ছোট  , বড়, ধনী  , গরিব, সাদা , কালো  , বাদামি , হলুদ, ফরাসি , চৈনিক , সিরীয় , ভারতীয়,  আরব , ওলন্দাজ- আমরা সব এক। দেশে দেশে যে বেড়া দিয়েছি, তা নিতান্তই অর্থহীন।

ইমেজ ক্রেডিট- ফেসবুক 

কাউকে মাটিতে চাপা, কাউকে আগুনে পুড়ে, আবার কাউকে ইলেকট্রনিক্স হিটারে, এমন করে প্রানহীন শরীর টাকে দাহ করা হবে! পাশে কেউ থাকবে  না!  যাদের জন্য দিন রাত পরিশ্রম তারাও থাকবে  না! যাদের সাথে এক প্লেটে বসে খাবার খাওয়া  , তারাও পাশে থাকবে না ! এখানে পুড়তে থাকবে নিজের সমস্ত অহংকার, রাগ, অভিমান, দম্ভ, ক্রোধ, হিংসা, লোভ, লালসা, সমস্ত শরীরের  অঙ্গ প্রত্যঙ্গ! এই দেহ পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে ! এই কয়লার কালো ছাই ছাড়া আর কিছু থাকবে  না শ্মশানে ! সেই ছাই এর মাঝে লেখা থাকবে না কোনো কোটিপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মাষ্টার, লেবার, শ্রমজীবি, কৃষক, উচ্চ বংশ, নিম্ন বংশ, কে ধনী ,কে গরীব! আর এইটাই চিরন্তন সত্য সবাইকে একদিন এই পথের পথিক হতে হবেই!
ইমেজ ক্রেডিট- ফেসবুক 



Comments

Popular posts from this blog

" করোনা " থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ------স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভবিষ্যতের আক্রমণ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম পদক্ষেপ হলো বায়োটেকনোলজি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফোকাস ।

করোনার প্রেক্ষিতে সনাতনী আচার যা অসম্ভব রকমের বিজ্ঞানভিত্তিক অভ্যাস ।